Published : 01 Sep 2025, 03:43 AM
বইটির নাম নিয়ে আলোচনার সময় আমার যুক্তরাজ্যের প্রকাশক সাইমন প্রসার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, 'আজাদী' শুনলে আপনার মনে প্রথমে কী আসে? আমি কোনো কিছু না ভেবেই উত্তর দিয়েছিলাম, 'একটি উপন্যাস।' নিজেও বেশ অবাক হয়েছিলাম এত তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়ে। উপন্যাস লেখককে দেয় এক অদ্ভুত স্বাধীনতা-যতটা জটিল হওয়া দরকার, ততটাই হতে পারে সে। চাইলে সময়, ভাষা আর বিশ্বের ভেতর দিয়ে, সমাজ, সম্প্রদায় আর রাজনীতির ভেতর দিয়ে অবাধে চলাচল করতে পারে। উপন্যাস কখনোই ঢিলেঢালা বা এলোমেলো নয়, বরং জটিলতাই তার সৌন্দর্য। আমার কাছে উপন্যাস মানে হলো যে স্বাধীনতায় দায়িত্ববোধ থাকে। সত্যিকারের মুক্তি, আজাদী। এই বইয়ের প্রবন্ধগুলোর কিছু লেখা হয়েছে এক উপন্যাসিকের চোখ দিয়ে, তার কল্পনার জগৎ থেকে। কিছু প্রবন্ধ বলছে কীভাবে কল্পকাহিনি বাস্তবের সঙ্গে মিশে যায়, সত্যি হয়ে ওঠে। সবগুলো লেখাই ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে। কিন্তু ভারতে এ দুই বছর যেন মনে হয়েছে দুই শতাব্দী! এই সময়ে, যখন করোনা মহামারি আমাদের গ্রাস করছে, আমাদের পৃথিবী যেন এক অজানা গন্তব্যের দিকে পা বাড়াচ্ছে। আমরা এমন এক স্থানে পৌঁছেছি, যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব বলেই মনে হয়-অন্তত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত অতীতের সঙ্গে কোনো গুরুতর ফাটল সৃষ্টি না করে তা সম্ভব নয়। এই সংকলনের শেষ প্রবন্ধটি তা নিয়েই লেখা। করোনা ভাইরাস আমাদের 'আজাদী'র ধারণা দেখিয়েছে এক ভয়াবহ, নতুন রূপে। এই 'মুক্ত ভাইরাস' আন্তর্জাতিক সীমানাকে করে তুলেছে অর্থহীন, সমগ্র জনবসতিকে বন্দী করেছে এবং আধুনিক বিশ্বকে এমনভাবে থামিয়ে দিয়েছে, যা আগে আর কোনো কিছুই পারেনি। এটি আমাদের এত দিনের জীবনযাত্রার ওপর ভিন্ন এক আলো ফেলেছে। আমাদের আধুনিক সমাজগুলোর মূল ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছে-আমরা এত দিন কোন মূল্যবোধকে পূজা করেছি, আর কোনটিকে বিসর্জন দিয়েছি। এই মহামারির দ্বার পেরিয়ে আমরা যখন এক নতুন জগতে প্রবেশ করছি, তখন প্রশ্ন উঠছে-কী সঙ্গে নিয়ে যাব, আর কী ফেলে যাব পেছনে? হয়তো সব সময় আমাদের হাতে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তবু ভেবে না দেখার সুযোগও নেই। আর ভেবে দেখতে গেলে আমাদের দরকার অতীতের আরও ভালো বোঝাপড়া-কীভাবে আমরা এ ধরণিকে ধ্বংস করেছি; কিংবা মানুষ কীভাবে মানুষের অন্যায়, অবিচারকে সহজে মেনে নিয়েছে। আশা করি, মহামারির আগে লেখা এই প্রবন্ধগুলো অন্তত সামান্য হলেও আমাদের সেই শূন্যস্থান পেরোতে সাহায্য করবে। আর না করলেও ভবিষ্যতের কোনো ইতিহাসবিদের কাছে এগুলো হয়তো হয়ে উঠবে এক রকমের দলিল। বিমান যেভাবে রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করে, তেমনি যেন আমরা সবাই মিলে উড়াল দিয়েছিলাম এক অজানা গন্তব্যের দিকে। প্রথম প্রবন্ধটি হলো ডব্লিউ জি সেবাল্ড লেকচার অন লিটারারি ট্রান্সলেশন, যা আমি ২০১৮ সালের জুনে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে দিয়েছিলাম। সেখানে ভাষার বিভাজন নিয়ে আলোচনা করেছি; যে ভাষাটিকে আমরা একসময় 'হিন্দুস্তানি' বলতাম, সেটিকে ছেঁটে দুটি আলাদা ভাষা আর লিপিতে রূপ দেওয়া হলো-হিন্দি আর উর্দু। ভুলভাবে একটিকে হিন্দুদের, আরেকটিকে মুসলমানদের ভাষা হিসেবে দাঁড় করানো হলো।
এক শতাব্দী আগেই এই বিভাজন বর্তমান হিন্দু জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিল। আমাদের অনেকেরই আশা ছিল, ২০১৮ সালই হবে নরেন্দ্র মোদি আর তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের শেষ বছর। তাই এই বইয়ের শুরুর দিকের প্রবন্ধগুলোয় সেই আশার প্রতিফলন আছে। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছিল, জনমত জরিপগুলো মোদি ও তার দলের জনপ্রিয়তা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তবে আমরা বুঝতে পারছিলাম, এটা খুবই নাজুক মুহূর্ত। অনেকেই আশঙ্কা করছিলাম, কোনো ভুয়া হামলা বা যুদ্ধ বাঁধানো হবে, যাতে দেশের মেজাজই বদলে যায়। সেই ভয়ের কথাই লিখেছিলাম 'ইলেকশন সিজন ইন আ ডেঞ্জারাস ডেমোক্রেসি' প্রবন্ধে (৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। ভয়টাই সত্যি হলো। নির্বাচনের ঠিক আগে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরে এক আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন সেনা নিহত হলো। ভুয়া কি না, তা বলা গেল না, কিন্তু সময়টা ছিল নিখুঁত। মোদি আর বিজেপি বিপুল ভোটে ফিরে এল ক্ষমতায়। তারপর-দ্বিতীয় মেয়াদের এক বছরের মধ্যেই মোদি এমন সব পদক্ষেপ নিলেন, যা যা ভারতকে চেনা-অচেনার সীমানা মুছে একেবারেই অপরিচিত করে দিল। আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফ্যাসিবাদের অবকাঠামো, মহামারি সে ফ্যাসিবাদ তৈরির প্রক্রিয়াকে অকল্পনীয়ভাবে ত্বরান্বিত করছে, আর আমরা এখনো শঙ্কিত তার প্রকৃত নাম উচ্চারণ করতে। এই বইয়ের ভূমিকাটি লেখা শুরু করেছিলাম ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পরিবারসহ ভারতে সরকারি সফরে ছিলেন। এই লেখাকেও পেরোতে হয়েছে মহামারির সেই অজানা দ্বার। ৩০ জানুয়ারিতে ভারতে প্রথম করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। কিন্তু সরকার কোনো গুরুত্বই দেয়নি। আর এদিকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে তার বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ২০০ দিন পেরিয়ে গেছে; সেখানে চলছে কঠোর তথ্য-অবরোধ। আর আর দুই মাসের বেশি সময় ধরে নতুন মুসলিমবিরোধী অসাংবিধানিক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদ করছে। জনসভায় উপস্থিত সবাই মোদি-ট্রাম্পের মুখোশ পরে এসেছিল। ট্রাম্প ভাষণে বললেন, ভারতীয়রা নাকি ক্রিকেট খেলে, দিওয়ালি উদযাপন করে আর বলিউড সিনেমা বানায়। এভাবে যেন আমাদের নিজেদের সম্পর্কে নতুন তথ্য জানালেন তিনি, কৃতজ্ঞ হলাম। আর আড়ালে বিক্রি করে গেলেন ৩ বিলিয়ন ডলারের এমএইচ-৬০ হেলিকপ্টার। ভারত খুব কমই এমনভাবে জনসমক্ষে নিজেকে লজ্জিত করেছে। যে দিল্লির হোটেলের গ্র্যান্ড প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটে রাত কাটাচ্ছিলেন, আর যে হায়দরাবাদ হাউসে মোদির সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চলছিল-সেই অট্টালিকার খুব কাছেই তখন দাউদাউ করে জ্বলছিল দিল্লি। উত্তর-পূর্ব দিল্লির শ্রমজীবী মুসলিম পাড়াগুলোয় হিন্দু উগ্রবাদীরা, পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় হামলা চালায়।
নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা প্রতিবাদে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদেরা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে আসছিলেন, ফলে সহিংসতার আভাস আগে থেকেই ছিল। হামলা শুরু হলে পুলিশ হয় দাঁড়িয়ে রইল, নয়তো সহায়তা করল আক্রমণকারীদের। মুসলমানরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল। পুড়ল তাদের দোকানপাট, ঘরবাড়ি। একজন পুলিশ সদস্যসহ অনেকেরই মৃত্য ঘটল। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও ছিল অনেক। ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছিল সব ভয়ঙ্কর ভিডিও। এক ভিডিওতে দেখা গেল-গুরুতর আহত তরুণ মুসলিম যুবকদের রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে; কয়েকজনকে পুলিশের পোশাক পরা সদস্যরা একে অপরের ওপর স্তূপ করে রেখেছে, আর তাদের জাতীয় সংগীত গাইতে বাধ্য করা হচ্ছে (তাদের মধ্যে ফাইজান নামে একজন পরে মারা যান, পুলিশের লাঠি তার গলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল)। এই ভয়াবহতার মাঝেও ট্রাম্প কোনো মন্তব্য করলেন না। বরং মোদিকে দিলেন 'জাতির পিতা' উপাধি; যা একসময় গান্ধীর ছিল। আমি গান্ধীর ভক্ত নই, তবে এতটুকু বলতে পারি, এমন অবমাননা তারও প্রাপ্য ছিল না। ট্রাম্প চলে যাওয়ার পরও সহিংসতা কয়েক দিন ধরে চলতে থাকে। ৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। প্রায় ৩০০ মানুষ গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাজারো মানুষ আশ্রয় নেয় শরণার্থীশিবিরে। সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের প্রশংসা করলেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বক্তৃতা দিয়ে দোষ চাপালেন মুসলমানদের ওপর-তারা নাকি নিজেরাই নিজেদের দোকান, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, নিজেরাই নিজেদের মেরেছে। মিডিয়া আর ট্রল বাহিনী একযোগে এ হত্যাযজ্ঞকে 'দাঙ্গা' বলে প্রচার করল। অথচ এটা দাঙ্গা ছিল না, এটি ছিল সশস্ত্র, ফ্যাসিবাদী জনতার দ্বারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত গণহত্যার প্রচেষ্টা। আর তখনো লাশ ভেসে উঠছিল ময়লার স্তূপে। এর মধ্যেই সরকার বসল ভাইরাস নিয়ে প্রথম বৈঠকে। পরে ২৪ মার্চ, মোদি যখন লকডাউন ঘোষণা করলেন, তখন ভারত যেন নিজের ভেতরের সব গোপন ক্ষতকে নগ্ন করে দেখাল দুনিয়াকে। এখন প্রশ্ন হলো-আমাদের সামনে কী অপেক্ষা করছে? উত্তর একটাই-এই পৃথিবীকে নতুনভাবে কল্পনা করা। তার বাইরে আর কোনো পথ নেই। ৬ এপ্রিল, ২০২০ অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন।